Image-Description
Stories
এক যে ছিল মেয়ে
Feb 21 2025 Posted by : montajpublishing

মেয়েটি ছোটবেলাতেই হারিয়েছিল তার বাবাকে। হারিয়েছিল তাদের জন্মভিটে, পাকিস্তান থেকে শরণার্থী হয়ে অসমের কাছাড় জেলার শিলচরে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। তোমরা কেউ কেউ হয়তো বুঝতে পারছ আমি কার কথা বলছি, হ্যাঁ ঠিক ধরেছ! পৃথিবীর ইতিহাসে মাতৃভাষার জন্য জীবন উৎসর্গকারী একমাত্র নারী ভাষা শহীদ ষোলো বছরের কিশোরী কমলা ভট্টাচার্য, আজ আমি তার গল্পই শোনাব তোমাদের।

কমলা ভট্টাচার্য বাবা রামরমণ ভট্টাচার্য ও মা সুপ্রবাসিনী দেবীর কোল আলো করে এসেছিল ১৯৪৫ সালে অসম প্রদেশের সিলেটে। কমলার যখন দুই বছর বয়স তখন দেশভাগ হয়ে যায়। এর ফলে ওদের বাড়ির অংশ চলে যায় পাকিস্তানে। তখনও ওরা দেশ ছেড়ে আসেনি কিন্তু ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন শুরু হলে কমলার পরিবার এদেশে চলে আসে। শিলচর পাবলিক স্কুল রোডের একটা ভাড়া বাড়িতে থাকতে শুরু করে।

তিন ভাই, চার বোনের মধ্যে কমলা ছিল তৃতীয় বোন। খুব ছোটবেলাতেই কমলারা পিতৃহীন হয়। কিন্তু সব ভাইবোনেদের ছিল পড়ার প্রতি খুব আগ্রহ। তাই অভাব-অনটনের মধ্যেও কেউ পড়া বন্ধ করেনি। কমলা পাঁচ বছর বয়সে ভর্তি হয় শিলচরের ছোটেলাল শেঠ ইনস্টিটিউটে। কিন্তু বই-খাতা জোগাড় করা ছিল কঠিন। বড়দিদি বেণু ভট্টাচার্য নার্সের চাকরির প্রশিক্ষণ নিতে শিমুলগুড়ি চলে গিয়েছিল আর মেজদিদি একটা স্কুলে চাকরি করত। তবে বেতন ছিল খুবই অল্প, তাই দিয়েই কোনরকমে সংসার চলত। এত অভাবের মধ্যেও দমে যায়নি কমলা। বন্ধুদের কাছ থেকে বই চেয়ে নিয়ে খাতায় লিখে রাখত, বই ফেরত দিতে একটু দেরী হলে কথা শোনাত কেউ কেউ। কমলা মেধাবী ছাত্রী ছিল, তাই এত কষ্ট করে পড়লেও প্রত্যেক শ্রেণীতে ভালো রেজাল্ট করত।

অভাবের সংসারে মাকে সাহায্য করত হাতের কাজ করে। কখনো বা পাটি বুনত খেজুর গাছের পাতা দিয়ে আবার কখনো সূঁচ-সুতো দিয়ে কাপড়ে নকশা করত। কষ্ট হলেও কমলা ঠিক করেছিল কিছুতেই পড়াশোনা ছাড়বে না। কমলার ইচ্ছে ছিল ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবার পর কয়েকমাসের ছুটির মধ্যে টাইপ রাইটিং শিখে নেবে। তারপর বি.এ পাশ করবে, চাকরি করে সংসারের অভাব ঘোচাবে। মাত্র ষোলো বছরের মেয়ে হলেও কমলার ভাবনা-চিন্তা ছিল অন্যরকম। সে কারণেই পড়াশোনা ছাড়াও খোঁজ রাখত বাংলা ভাষাকে সরকারী ভাষার স্বীকৃতি আদায়ের আন্দোলনের।

কমলা ভট্টাচার্যের ঝাপসা হয়ে যাওয়া ছবি দেখে সকলেরই মনে হয় ঐটুকু বাচ্চা মেয়ের মধ্যে ছিল সাহসিকতা, অদম্য জেদ। কমলা ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো একটি মেয়ে। কমলার মুখে একটাই কথা, ‘জান দেব তবু জবান দেব না’।

তোমরা যারা মাধ্যমিক পরীক্ষা দাও তারা তো প্ল্যান করে রাখো, কয়েকদিন আনন্দ করে বেড়াবে তারপর ইলেভেনের পড়া শুরু করবে। কমলা ও তাই ভেবেছিল, পরীক্ষা শেষ হলে মাসির বাড়ি যাবে তারপর টাইপ রাইটিং শিখবে। কিন্তু তা তো হল না, ১৯৬১ সালের এপ্রিল মাসে শুরু হল পরীক্ষা আর শেষ হল ১৭ই মে। ১৮ তারিখ কমলা বেশ আনন্দেই ছিল, যা পরীক্ষা দিয়েছে তাতে পাশ করে যাবে ঠিক। যদিও বড় অভাব ছিল সংসারে, ঠিকমত খেতে পেত না। বই তো ছিলই না, তবুও আশা ছিল পাশ করে যাবে।

১৮ই মে বিকেলে কমলা খবর পেল পরদিন শিলচর রেলষ্টেশনে মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার দাবিতে পিকেটিং এর ডাক দেওয়া হয়েছে। কমলা তখনই ঠিক করে ফেলেছিল ও পিকেটিং এ যাবে। আসলে স্কুলে পড়াকালীন কমলা নিয়মিত খোঁজ রাখত ভাষা আন্দোলন কত দূর এগোল। এই খবর পেত স্কুলের বান্ধবীর ভাইয়ের কাছ থেকে।

১৯৬০ সালের এপ্রিলে, আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটিতে অসমীয়া ভাষাকে একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে ঘোষণা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। অসমীয়া ভাষার উত্তেজিত জনতা বাঙালিদের আক্রমণ করে। তখন প্রায় ৫০০০০ হাজার বাঙালি হিন্দু ব্রহ্মপুত্র এলাকা ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে যায়। ৯০০০০ হাজার লোক বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে যায়। এসব খবর শুনে কমলার খুব রাগ হত, দুঃখ হত, ওরা কি শুধু তাড়াই খাবে? নিজেদের ভিটে-মাটি ছেড়ে চলে এসে ভাড়া বাড়িতে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। খিদেয় মায়ের কাছে ভাত চাইলে ভাত দিতে না পারার জন্য মা কাঁদত। খুব কষ্ট হত কমলার, ও কেবলই ভাবত পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করে সবাই মিলে পেট ভরে ভাত খাবে। কিন্তু যদি নিজের ভাষায় কথা বলার অধিকার না থাকে তবে পড়াশোনা শিখে কি চাকরি পাবে? এসব নিয়ে বন্ধুর সাথে আলোচনা করত।

বন্ধুর ভাইয়ের কাছ থেকে আরো ভয়াবহ ঘটনার খবর পেল, গোরেশ্বর অঞ্চলের ২৫ টি গ্রামের ৪০১৯ টি কুঁড়েঘর আর ৫৮ টি বাড়ি ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। নয়জন বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে, ১০০ র বেশি লোক আহত হয়েছে। 

সেই সময় আসামের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বিমলা প্রসাদ চালিহা। তিনি অসমীয়া ভাষাকে অসমের একমাত্র সরকারী ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি বিধানসভায় আদায় করে ছেড়েছিলেন। উত্তর করিমগঞ্জের বিধায়ক রণেন্দ্রমোহন দাস এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন কিন্তু স্বাভাবিক ভাবেই “জোর যার মুলুক তার” এই প্রবাদের বিচারে তিনি পরাস্ত হন।

এত অভাব, খিদের কষ্ট, জামা-কাপড়ের কষ্ট, বইপত্র নেই তবুও কমলার মনে হত ওর হাতে যদি ক্ষমতা থাকত তাহলে ও এই অন্যায়-অত্যাচার করা লোকগুলোকে শাস্তি দিত। কিন্তু সে ছিল কোমল মনের একটি মেয়ে কিন্তু বাস্তব যে বড় কঠিন। তাই তার মা, দিদি বোঝাত এসবে মন না দিতে। সব গল্প মেজদিদির সাথে করত কমলা। দিদি বোঝাত এই সমাজ পাল্টাতে হলে কমলাকে অনেক বড় হতে হবে। কমলা বড় হবার অপেক্ষায় ছিল কিন্তু তার আগেই ঘটে গেল ভয়ংকর ঘটনা। যে ঘটনার বিবরণ পড়লে এখনো আমাদের চোখ জলে ভরে ওঠে।

কমলা খবর পেয়েছিল ১৯ শে মে শিলচর রেল স্টেশনে মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার দাবিতে পিকেটিং এর ডাক দেওয়া হয়েছে। কমলা ঠিক করেছিল পিকেটিং এ যাবে, কিন্তু বাইরে যাবার মত কাপড় ওর নেই, তাই মেজদিদি যে কাপড় পরে স্কুলের চাকরিতে যায় সকালে স্নান সেরে দিদির শাড়ি-ব্লাউজ পরে কমলা তৈরী হয়। কিন্তু মায়ের কাছে ভাত চাইলে মা ভাত দিতে পারেন না কারণ তখনো খাবার জোগাড় করা হয়ে ওঠেনি। তাছাড়াও কমলার মা কিছুতেই মেয়েকে ওই বিপদের মধ্যে যেতে দিতে চাননি। তিনি জানতেন ওখানে গেলে অশান্তি হবেই।

ঠিক সেই সময় বাংলা ভাষা আন্দোলনের নেত্রী জ্যোৎস্না চন্দের নেতৃত্বে ২০-২২ জনের একটি মেয়েদের দল কমলাকে নিয়ে যাবার জন্য ওদের বাড়ি আসে। এদিকে কমলার সাথে যাবে বলে কমলার ছোট বোন মঙ্গলা, ছোট ভাই বকুল ও বড়দির ছেলে বাপ্পা বায়না করছে। কিন্তু কমলার মা, মেজদি কেউই রাজী নয় ওই সব ঝামেলায় জড়াতে। শেষে কি না কি বিপদ হবে! কিন্তু কমলাও জেদ ধরেছে যাবে, অন্যরাও বোঝাচ্ছে আমরা সবাই যাচ্ছি কোনো ভয় নেই। কিন্তু মায়ের মন কেমন যেন কু গাইছিল কিন্তু শেষমেষ কমলার জেদের কাছে মাকে হার মানতে হল। সেই সঙ্গে ছোটো বাচ্চারাও গেল, যাবার আগে কমলা মা-কে কথা দিয়েছিল দুপুরের আগেই সবাইকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসবে। সুপ্রবাসিনী দেবী যখন দেখলেন ওরা যাবেই তখন একটুকরো ছেঁড়া কাপড় কমলার হাতে দিয়েছিলেন, কাঁদানে গ্যাসের হাত থেকে এই ভিজা কাপড়ের টুকরো রক্ষা করবে।

ওরা যখন স্টেশনে এসে পৌঁছয় দেখে প্রচুর লোকে হাতে প্ল্যাকার্ড, ব্যানার নিয়ে স্লোগান দিচ্ছে ‘জান দেব তবু জবান দেব না’। ‘মাতৃভাষা জিন্দাবাদ, বাংলাভাষা জিন্দাবাদ’।

ভাবতে পারছ মাতৃভাষার জন্য ভয়কে জয় করে সবাই এগিয়ে এসেছিল। এদিকে বেলা একটা বেজে গেলেও কমলারা না ফেরায় ওর মা নিজেই চলে আসেন রেলস্টেশনে। মাকে দেখতে পেয়ে কমলা ছুটে আসে মায়ের কাছে, জল দিয়ে মায়ের পায়ের ধুলো ধুয়ে দিয়ে সরবত খাওয়ায়| মাকে বলে চিন্তা না করতে, আরেকটু পরেই ওরা বাড়ি চলে যাবে। মায়ের সাথে ছোট ভাই ও দিদির ছেলেকে পাঠিয়ে দেয়। পুলিশ ওদের আটক করেছিল, কিছুক্ষণ পরে ছেড়ে দিয়েছিল তাই ওদের মায়ের সাথে পাঠিয়ে দেয়। যদিও এসব কথা মাকে বলেনি তাহলে মা ভয় পাবেন।

সকাল থেকে আন্দোলন শান্তিপূর্ণ ছিল, কোনো গন্ডগোল হয়নি। মাতৃভাষার দাবিতে কমলা সহ অন্য ছাত্র-ছাত্রীরা স্লোগান দিচ্ছিল। সন্ধ্যে ৬ টায় এই পিকেটিং শেষ হয়ে যাবার কথা। কিন্তু হঠাৎ করে দুপুরের পর থেকে অসম রাইফেলসের জওয়ানরা জায়গাটা ঘিরে ফেলতে শুরু করে| বেলা ২ টো ৩৫ মিনিটের সময় তারা অবস্থাকারী ছাত্র-ছাত্রীদের উপর নির্বিচারে লাঠি ও বন্দুকের কুঁদো দিয়ে পেটাতে শুরু করে| এইসময় ভয় পেয়ে সবাই যে যেদিকে পারে ছুটে পালাতে থাকে। কমলার ছোট বোন মঙ্গলা লাঠির আঘাতে মাটিতে পড়ে সাহায্যের জন্য দিদিকে ডাকতে থাকে। কমলা ছুটে এসে বোনকে বাঁচাতে গেলে একটা গুলি কমলার চোখ ভেদ করে তার মাথার খুলি চুরমার করে দেয়।

সেইসময় প্যারামিলিটারী বাহিনী আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে ১৭ রাউন্ড গুলি চালায়। তার ফলে নয় জন তখনই মারা যায় আর বাকি দু’জন পরে।

কমলা নিজের মাতৃভাষাকে ভালোবেসে নিজের প্রাণ দিয়েছিল। বোন মঙ্গলাকে বাঁচাবার চেষ্টা করেছিল, মঙ্গলা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু বাকি জীবন শারীরিক ও মানসিকভাবে পঙ্গু হয়ে যায়। হৃদয়বিদারক এই ঘটনায় কমলার মেজদিদি, যে ছিল সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী সেও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে।

বাংলা ভাষার জন্য, মাতৃভাষার জন্য মাত্র ষোলো বছরের কিশোরী মেয়ে মা, দিদির ডাককে উপেক্ষা করে গিয়েছিল মিছিলে। দু’চোখে অজস্র স্বপ্ন, নিত্য অভাবের সংসারে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্নে বিভোর কিশোরী মেয়েটি অপমান সইতে পারেনি নিজের মাতৃভাষার নিজের প্রাণ উৎসর্গ করে রেখে গেল মাতৃভাষার মান। সেইসাথে ইতিহাসের বুকে জায়গা করে নিল পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম নারী ভাষা শহীদ হিসাবে।

শহীদদের রক্ত বৃথা হয়নি, অসম সরকার বাধ্য হয়েছিল বাংলা ভাষাকে দাপ্তরিক ভাষার স্বীকৃতি দিতে।

কমলার গল্প বলতে গিয়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে, চোখ ভরে উঠছে জলে। যতদিন বাংলা ভাষা থাকবে ততদিন কমলা ভট্টাচার্যের নাম থাকবে চির ভাস্বর হয়ে।

অর্থ নয়, অলঙ্কার নয়, নয় রেশম শাড়ি, শুধুমাত্র মাতৃভাষার জন্য জীবন দিতে ভয় পায়নি কিশোরী কমলা ভট্টাচার্য। তাঁকে জানাই প্রণাম| তিনি মাতৃভাষার জন্য লড়াই না করলে এই গল্পটা লেখাই হত না বাংলাভাষায়।

-সবিতা রায় বিশ্বাস


Popular Books


Comments

  • সুমিতা দাশগুপ্ত

    তথ্যমূলক হৃদয়বিদারক ভাষা শহীদের কাহিনী, আজকের দিনে খুবই প্রাসঙ্গিক।

    Feb 21 2025
  • Ranu Sil

    অনেক তথ্য পেলাম। বেশ ভালো লাগল।

    Feb 21 2025

Write a Comment