Image-Description
Stories
ও আমার বর্ণমালা
Feb 19 2025 Posted by : montajpublishing

অন্তুর শরীরটা ভাল নেই। মনটাও।

সপ্তাখানেক আগে বাড়ির গাছে পেয়ারা পাড়তে উঠেছিল। ছোটভাই রন্তুর বায়নায়। পেয়ারা গাছটা ওদের বাড়ির কলতলার পাশেই। বেশ ঝাঁকড়া গাছ। অনেক ডালপালা ছড়িয়ে আছে চারদিকে। গাছের মগডালে দু তিনটে ডাসা পেয়ারা দেখে রন্তু দাদাকে বলেছিল 
― দাদা, পাড় না ক'টা পেয়ারা‌। দু'জনে বেশ মজা করে নুন মেখে খাওয়া যাবে।

অন্তুরও লোভ হয়েছিল।

ছোট্ট একটা লগা হাতে অন্তু উঠে পড়েছিল গাছে। কটা পেয়ারাও পেড়ে ফেলেছিল। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো শেষ পেয়ারাটা পাড়তে গিয়ে। পা ফসকে সোজা মাটিতে। আর বেমোড়ে পড়ে ডান পা-টায় চোট লেগেছিল ভয়ানক রকমের। তারপর ডাক্তার। ব্যান্ডেজ। পনের দিন বিছানায় থাকার ফরমান জারি।

আগামীকাল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। প্রতি বছরের মতো পাড়ার ক্লাবের মাঠে চলবে সারাদিনব্যাপী অনুষ্ঠান। সকালে শহীদ বেদীতে মাল্যদান। প্রভাত ফেরী। বিকেলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

সকালের প্রভাত ফেরী ও শহীদ স্মৃতিতে মাল্যদান - দু'টোতেই অংশ নেওয়ার ইচ্ছে ছিল অন্তুর। আর বিকেলে কবিতাপাঠও।

কিন্তু কিছুই সে করতে পারবে না। তাই অন্তুর মনটা খুব খারাপ।
চুপচাপ বিছানায় শুয়ে শুয়ে এইসব ভাবছে অন্তু।
― দাদা...
হঠাৎ রন্তুর কন্ঠস্বরে ভাবনায় ছেদ পড়ে অন্তুর।
অন্তু নবম শ্রেণী আর রন্তু সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। একই স্কুলে।

রন্তু বলে
― দাদা, স্যার বলেছেন আমাদের স্কুলেও মাতৃভাষা দিবস পালন করা হবে। সকাল ৭ টার আগে স্কুলে যেতে বলেছেন স্যার।
অন্তু গলায় একটু হতাশা মেখে বলে
― কিন্তু এবার আর আমার মাতৃভাষা দিবস পালন করা হবে না। স্কুলেও যাওয়া হবে না। আর ক্লাবের অনুষ্ঠানেও যাওয়া হবে না।

রন্তু আফশোসের সুরে বলে- সবই আমার জন্যে দাদা। সেদিন যদি আমি পেয়ারা পেড়ে দিতে বায়না না করতাম তাহলে তোর পা ভাঙত না।

― না না ভাই। তোর কী দোষ? আমি যদি একটু সাবধান হতাম তাহলে পড়তাম না। কতই তো গাছে উঠি! কই আগে কোনো দিন পড়িনি তো?

রন্তু বলে
― আমিও একা একা স্কুলে যাব না। ক্লাবের মাঠেও যাব না। তুই না গেলে আমার একা একা ভাল লাগবে না দাদা।

অন্তু বলে,
― দুর বোকা, আমি যাব না বলে তুই যাবি নে কেন ? সৌম্য, ঋক, প্রীতম ওদের সঙ্গে চলে যাবি।

― আমি গিয়ে কী করব? তোর মতো তো কবিতা লিখতেও পারিনে আর কবিতা আবৃত্তি করতেও পারি নে। আর সবচেয়ে বড় কথা তুই যাবি নে আর আমি যাব? কখনোই না।

অন্তু কিছু একটা ভেবে নিল।  তারপর বলে
― আচ্ছা, সে হবে'খন। তুই ভোরে উঠে বাগান থেকে ফুল তুলে মালা গাঁথবি। আর...
রন্তু সোৎসাহে বলে
― আর কী দাদা?

― আসলে...অন্তু বলে মাতৃভাষা আর ভাষাশহীদদের প্রকৃত সম্মান জানানো হয় কী করলে জানিস?
― কী? 
― মায়ের ভাষাকে ভালবেসে...
― সেটা কীভাবে?
― আজ রাতে ভেবেভুবে তুই বাংলা ভাষা সম্পর্কে তোর অনুভূতিতে লিখে ফেলবি। আর সেটাই কাল স্কুলে পড়বি।
― আমি তো তোর মত লিখতে পারিনা দাদা। তুই কী সুন্দর কবিতা লিখিস! আমাকে তুইই একটা কবিতা লিখে দিস্, সেটাই পড়ব।

― না না ! তুইও পারবি। চেষ্টা কর। আর একটু কম ভালো হলেই বা ক্ষতি কী?

-আচ্ছা, তুই যখন বলছিস। লিখব। বলে রন্তু কিছুক্ষণ চুপ করে কী যেন ভাবল।
তারপর বলল
― তুই তো কোথাও যেতে পারবি নে দাদা। তোর তো মাতৃভাষা দিবসে কিছুই করা হবে না এবার!
অন্তুর মনেও তার জন্য কষ্ট হচ্ছে তবু ভাইকে সেটা বুঝতে না দিয়ে বললো,
― আমি আমার ভাষাকে ভালবাসি। কবিতা লিখি বাংলা ভাষায়। বই পড়ি বাংলা ভাষার। আমার কাছে প্রতিদিনই মাতৃভাষা দিবস।
বলে হয়তো নিজেও একটু নিজের কষ্টের সান্ত্বনা পেতে চাইল অন্তু।

একুশের ভোর। ক্লাবের মাঠ থেকে ভেসে আসছে 
― মোদের গবর মোদের আশা আ মরি বাংলাভাষা... গানের মন কেমন করা সুর।
অন্তু মুগ্ধ উদাস মনে ডুবে আছে সেই সুরের মূর্চ্ছনায়। আর মনে মনে গেয়ে চলেছে ― মোদের গবর মোদের আশা আ মরি....

রন্তু দুটো ফুলের মালা আর একটা খাতা হাতে দাদার খাটে এসে বসল।
বলল 
― দাদা, তোর জন্যও একটা মালা গেঁথেছি।
― কেন রে ভাই? আমি মালা দিয়ে কি করব?
-কেন? এখানে বসেই ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন তার উদ্দেশ্যে দিবি।
বাহ! ভালোই বলেছিস তো তুই। আগে তো আমার মাথায়ই আসেনি।
একমুহুর্ত ভাবল অন্তু। তারপর বলল,
― ভাই, আমার বইয়ের তাকে দেখ রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি বইটা রয়েছে। ওটা নিয়ে আয়।
দাদার ভাবনা বুঝতে না পেরে কৌতূহলের সাথে রন্তু বলে, ― কী হবে দাদা?
― সে পরে বলছি। আগে নিয়ে আয় তো। মৃদু হেসে অন্তু বলে।
রন্তু দাদার বইয়ের তাক থেকে গীতাঞ্জলি বইখানা এনে দাদার হাতে দেয়।
অন্তু বইটা হাতে নিয়ে বলে, 
― মাকে ব'লে একটা চৌকি একটু ভাল করে ধুয়ে নিয়ে আয়। তার উপরে বইটা রাখতে হবে।
এবার রন্তু দাদার পরিকল্পনার কিছুটা আঁচ করতে পারে। বলে, 
― আচ্ছা।
চৌকি এল। সযত্নে বই রাখা হল।
অন্তু বলল, 
― তুই কী লিখেছিস, পড় এবার।
রন্তু একটু কাঁচুমাচু করে পড়তে শুরু করল,
― বাংলা আমার মায়ের ভাষা
আমি বাংলাকে ভালবাসি,
এই ভাষাতেই পড়ি লিখি
দুখে কাঁদি সুখে হাসি।

― বাহ! খুব সুন্দর লিখেছিস তো ভাই। এটাই হ'ল মাতৃভাষার প্রতি আর ভাষাশহীদদের প্রতি প্রকৃত সম্মান দেওয়া।
অন্তু ভাইয়ের পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল
― নে, এবার তোর মালাটা এই গীতাঞ্জলি বইটাতে পরিয়ে দিয়ে প্রণাম কর।
দাদার কথা মত রন্তু একটা মালা বইটার চারপাশে বৃত্তাকারে সাজিয়ে রাখল। প্রণাম করল।
তারপর বলল,
― তুই এই মালাটা নে দাদা।
অন্তু ভাইয়ের হাত থেকে মালাটা নিল। জড়িয়ে দিল গীতাঞ্জলির হৃদয়ে।
তারপর পাশ থেকে তার কবিতার খাতাটা টেনে নিল হাতে। বের করল গত রাতে লেখা কবিতাটি। গভীর আবেগমাখা কন্ঠে পড়তে লাগল-
ও আমার     অ আ ক খ
ও আমার     বর্ণমালা
তুই আমার   ভালোর বাসা
হৃদয়ে          গন্ধ ঢালা

তুই আমার   অ-য় অজগর
আ য়ে আম  ছন্দে পড়া
তুই আমার   ডালিম গাছে
সুমধুর         মৌ-এর ছড়া

ও আমার     বর্ণমালা
তুই আমার   মায়ের হাসি
হৃদয়ের        বৃন্দাবনে
তুই আমার   শ্যামের বাঁশি

তুই আমার   বাবার বাহু
উঠোনে        ধানের গোলা
তুই আমার   ডাংগুলি আর
অশথের       শাখায় দোলা

ও আমার     অ আ ক খ
তুই আমার   ফাগুন প্রাণে
শিমূল আর   পলাশ রঙে
ফুটে রোস     কুহুর তানে

তুই আমার    ভাইয়ের লাটাই
পাঁয়জোর     বোনের পায়ে
তুই আমার    আউল বাউল
ভাটিয়াল       জীবন নায়ে

ও আমার      বর্ণমালা
আঁকি তোর   মোহন ছবি
মননের          সহজ পাঠে
তুই আমার     ঠাকুর রবি

তুই আমার    রূপকথাপুর
ও আমার      বাংলা ভাষা
আমি তোর    বর্ণ মেখে
লিখি রোজ    ভালবাসা ৷

খাটের এক কোণায় বসে রন্তু মুগ্ধ মনে শুনল দাদার পাঠ করা অপূর্ব মিষ্টি কবিতাটি।
কবিতাটা পড়ার শেষে অন্তু বলল,
― কেমন হল বল আমাদের মাতৃভাষা দিবস পালন?
রন্তু বলল,
― এর চেয়ে ভাল আর কি কিছু হতে পারে দাদা ?
একটু থেমে রন্তু আবার বলে, ― আচ্ছা দাদা, তোর এই কবিতাটাই আমি পাঠ করব স্কুলে। দিবি?
― অবশ্যই। বলে অন্তু খাতাটা তুলে দেয় ভাইয়ের হাতে।
রন্তু খাতাটা হাতে নিয়ে আনন্দ আত্মহারা হয়ে পড়তে থাকে ―
ও আমার     অ আ ক খ
ও আমার     বর্ণমালা
তুই আমার   ভালোর বাসা
হৃদয়ে          গন্ধ ঢালা...

-শংকর দেবনাথ


Popular Books


Comments

  • শংকর দেবনাথ

    ধন্যবাদ

    Feb 19 2025
  • Ranu Sil

    বাঃ সুন্দর।

    Feb 21 2025

Write a Comment