Image-Description
Stories
টুকটুকির প্রার্থনা
Feb 6 2024 Posted by : montajpublishing

কটকটি মেয়ে টুকটুকি কোমরে বাসন্তী রংয়ের শাড়ির আঁচল পেঁচিয়ে, গলায় একটা গাঁদাফুলের মালা পরে আপন মনে বকতে বকতে, ছুটতে ছুটতে নীলদের বাড়ি যাচ্ছিল। তাকে থামিয়ে ঘটনাটা শুনব বলে যেই ডাক দিয়েছি সেই আমাকে উল্টে পাঁচটা কথা শুনিয়ে দিল। তা যাক গে, ও না বললে কি আমি কথাটা জানতে পারব না! ওই তো ঘন্টু আসছে...

“এই ঘন্টু শোন ―"

“ও তুমিও শুনেছ? এ কথা কি আর চাপা থাকে ফুলুরি দাদু?”

“না, না চাপা থাকবে কেন? তাই কি থাকে?”

"তুমি যখন জেনেই ফেলেছ তখন শুধু শুধু আমাকে দেরী করিয়ে দিলে কেন? আমার এখন কত জনকে খবর দিতে হবে! আমি চললাম।"

যাঃ ঘন্টু চলে গেল? কি হয়েছে, না শুনলে পেটের মধ্যে কেমন যেন ভুটভাট করছে! চপ ফুলুরির দোকানটা কেবল সাজাচ্ছিলাম! যদিও জানি আজ তেমন বিক্রিবাটা হবেনা, সবাই দুপুরে সরস্বতী পুজোর খিচুড়ি খেয়েছে পেট ঠেসে।

নীলদের বাড়ি গিয়ে দেখি, আমি বাদে পুরো গ্রাম হাজির। সমানে বক্তিমে দিয়ে যাচ্ছে টুকটুকি। নীল আজকে স্বচক্ষে দেখেছে মা সরস্বতী একটা হলুদ রঙের শাড়ি পরে বীণা হাতে নিয়ে হেঁটে হেঁটে গ্রামের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। হাঁসটা প্যাঁক প্যাঁক করে হেলতে দুলতে মায়ের পিছন পিছন যাচ্ছে। নীল জিজ্ঞেস করেছে, “মা তুমি হাঁসের পিঠে না উঠে হেঁটে যাচ্ছ কেন?”

ঠিক এই সময় অর্ণব রুখে উঠল, “দ্যাখ টুকটুকি তোর সাথে নীলের বেশি ভাব বলে যা বলবি সবাই তাই বিশ্বাস করবে? এই প্রশ্নটা আমি মাকে করেছিলাম।"

“বেশ! এবার মা তার জবাবে তোকে কী বলেছিল সেটা বল!"

অর্ণব তোতলাতে তোতলাতে বলল, “মা বলল, টুকটুকিকে খুঁজছি। খুব পাকা মেয়ে, দেখতে পেলেই কান ধরে ওঠবোস করাব।”

সবাই হই হই করে উঠল, অর্ণব মিথ্যে কথা বলেছে সেটা হাতেনাতে ধরা পড়েছে। নীল বল্ তো, “মা সরস্বতী তোকে কী বলেছে?"

নীল কাঁদো কাঁদো মুখে বলল, "আমার পেট ব্যথা করছে।"

টুকটুকি কোমরে হাত দিয়ে বলল, “আমি জানতাম হবে, অত খিচুড়ি কেউ খায়? আমি তখনই বলেছিলাম! এখন হল তো?”

“তুই কখন বললি?”

“নীল কথা বলিসনে, পেটের ব্যথা বাড়বে। আমার কাজ আছে, কথা শেষ করেই চলে যাব।”

কথার মাঝখানে ফুলুরি দাদু বলল, "তুই কাজ করতে পারিস?”

ফুলুরি দাদুর দিকে ঘুরে বলল, “এখন থামতো দাদু। কথার মাঝে বাগড়া দিওনা। আমি কাজ না করলে সংসারটা এমনি এমনি চলে?”

“শোন কাকিমা নীলকে জোয়ানের আরক খাইয়ে দাও। আর এবার থেকে রোজ সকালে ব্রাহ্মী শাক ঘিয়ে ভেজে নীলকে গরম ভাতে খাইয়ে দিও। ঠাম্মা বলে এতে স্মিতিশক্তি বাড়ে, আজকাল নীল কিছুই মনে রাখতে পারেনা।”

টুকটুকির মুখে 'স্মিতি' শুনেই অর্ণব খপ করে ধরেছে| কিন্তু টুকটুকিকে দমানো কি অতই সোজা? ঘর ভর্তি লোকের সামনে গুম করে অর্ণবের পিঠে একখানা কিল মেরে বলে দিল, “খালি ছোটদের মুখে মুখে কথা, মা সরস্বতী বড় বড় চোখ করে দেখছেন। শিগগির মাকে পেন্নাম করে দোষ স্বীকার কর।"

মিনুকাকি বলল, “ও টুকটুকি তারপর কী হল বল মা! তাড়াতাড়ি বল, বাড়ি গিয়ে হাঁস মুরগি তুলব। মাঠে গরু বাঁধা আছে।”

“বলছি কাকিমা। মা বলল, হাঁস আমার বাহন ঠিকই তাই বলে অতটুকু একটা হাঁসের পিঠে চাপতে লজ্জা করেনা! যদি হাঁসগুলো সবাই বড় করে তাহলে পিঠে চাপা যায়। এখনো অনেক বাড়ির পুজো হয়নি, তারা সব উপোস করে রয়েছে। আমি না গেলে তারা মুখে জল দিতে পারবে না, তাই তাড়াতাড়ি করে যাচ্ছি।”

“বললাম মা, বীণা, পেসাদের থলে এত কিছু নিয়ে তুমি কি যেতে পারবে? থলেটা আমাকে দাও, আমি নিয়ে যাচ্ছি। মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে ভুজো আমার আঁচলে ঢেলে দিয়ে বলল তুই খা। আমি আরো পাব, সেগুলো নিয়ে গিয়ে নারান ঠাকুরকে খেতে দেব।"

সবাই দেখল, সত্যি টুকটুকির কোঁচড়ে মোয়া মুড়কি রয়েছে। নীলের মা এইবার বলল, “হ্যাঁ রে তুই তো প্রথমে বললি নীল, মা সরস্বতীকে দেখেছে। এখন বলছিস তুই দেখেছিস!”

“তুমি না কাকিমা কিছুই মনে রাখতে পারনা, নীল তো আমার সাথেই ছিল। ও কী করে একা দেখবে বলতো! নাও সরো তোমরা, পেসাদ নিতে এসে বকেই যাচ্ছি। ঠাকুরকে পেন্নাম করাই হয়নি।"

ঠাকুরকে পেন্নাম করতে যেই মাথা নীচু করেছে অমনি টুকটুকির মা এসে ঝাঁকড়া চুলের গোছা ধরে টেনে তুলে বলল, “এখানে একেবারে তোমার ঠাম্মার মত আসর সাজিয়ে বসেছ। কোঁচড়ে আবার খই মুড়কি! তাই বলি গামলা খালি কেন?”

এবারে টুকটুকি মোক্ষম চাল চাললো। মা সরস্বতীকে কেঁদে কেঁদে নালিশ জানালো, “মাগো, মা সরস্বতী  বিচার করো, তুমি তো ঠাকুর, তোমার চুল এত জোরে টানলে এতক্ষণ চুল উঠে মাথা ন্যাড়া হয়ে যেত, নেহাত আমি শক্ত মেয়ে তাই মাত্তর চারটে চুল উঠেছে। তোমার পুজো না হলে খই মুড়কি পাওয়া যেত? তোমার পেসাদ দিয়েছ বলে এত কথা শুনলে মা! সব ঠাকুরই এক, টুকটুকির মায়ের হাতের খই মুড়ি নীলের মায়ের বাড়ি বসে বসে খাও।"

কোঁচড়ের নাড়ু মুড়কি নীলদের পুজোর থালায় ঢেলে কাঁদতে কাঁদতে ছুটল ঠাম্মার কাছে।

আমি টুকটুকির মাকে বললাম, “বৌমা মেয়েটা তোমার মস্ত পন্ডিত হবে দেখো। এই সাড়ে পাঁচ বছরেই কেমন কথার জাদুতে এতগুলো লোককে বশ করে রেখেছিল। ক’জন এমন পারে বলতো! যেন সিনেমা দেখছিলাম। ওকে মারধোর কোরোনা।”

টুকটুকির মা বাড়ি এসে দ্যাখে টুকটুকি, ঠাকুমার সইদের বলছে, “ও সতু ঠাকুমা তোমার এতখানি বয়স হল তুমি কি কখনো পুজোর পরে মা সরস্বতীর হাঁসকে কৈলাশে উড়ে যেতে দেখেছ?"

“এ কী অলুক্ষুণে কথা বলছিস? তাই কখনো হয়?”

“হয় গো ঠাকুমা হয়। এ হল কলিকাল, আর ক’দিন পরে শুনবা মা সরস্বতীও শীতের জন্য নদীতে নামতে ভয় পাচ্ছে।"

“তা, কথাটা মন্দ বলিসনি টুকি, এ কথাখান কোনদিন ভেবে দেখিনি। ঠান্ডা জলে ধপাস করে ফেলে দিলে ঠাকুর ভয় পাবেই। এই জন্যি ছেলেপিলে অত ফেল করে।"

এই সময় টুকটুকির মা একখানা প্যাঁকাটি হাতে মেয়ের কান ধরে দু’ঘা বাড়ি মেরে বলল, “বল হাঁস কোথায়? হাঁস কৈলাশে উড়ে গিয়েছে, তাই না!”

“হ্যাঁ, আমি এই কথাটাই বলছিলাম।"

টুকির ঠাকুরমা বলল, “ও বৌমা কান ছাড়ো! তোমার কোনো আক্কেল নেই? মেয়ে কানে কালা হয়ে গেলে তবে বুঝবে!”

টুকির মা আলতো করে কান ধরে বলল, “হাঁস বের কর। তার আগে ওর পায়ের বাঁধন খুলে দে। মা আপনারা আনন্দে গল্প করছেন, আপনার নাতনি যে ওই সাদা হাঁসের বাচ্চাটাকে মা সরস্বতীর পায়ের সাথে বেঁধে রেখেছে তা দেখেননি? বেচারার ডেকে ডেকে গলা শুকিয়ে গেল!”

টুকটুকি রুখে উঠল, "আমি ওকে ছোটো ছোটো চারটে কেঁচো খেতে দিয়েছি।"

“শুনলেন মা শুনলেন? সে কেঁচো আমি দেখলাম না। হায় কপাল! এই মেয়ে নিয়ে আমি কী করি? এত জ্বালাতন আর সহ্য হয় না। কখন যে কী গল্প বানাচ্ছে, কী কাজ করছে তা ধরা খুব মুশকিল।"

টুকটুকি চোখ মুছতে মুছতে পুতুলের বাক্স থেকে মা সরস্বতীর হাঁস বের করে মায়ের পায়ের কাছে বসাল। তারপর জ্যান্ত হাঁসের বাচ্চাকে দড়ি খুলে ওর মায়ের কাছে দিয়ে এল। সব শেষে খুঁজে খুঁজে চারটে কেঁচো উদ্ধার করল, সবকটাই পিঁপড়ের কামড়ে প্রাণ ত্যাগ করেছে।

মায়ের কথামত জামা কাপড় ছেড়ে হাত পা ভালো করে ধুয়ে বিছানায় উঠে ঠাম্মার পাশে বসে মাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, “বুঝলে ঠাম্মা, তুমি সব সময় বলো যার কপালে যা লেখা আছে তাই হবে। আজ বুঝলাম কথাখান ঠিক। আমি চেষ্টা করলাম নদীর ঠান্ডা জল থেকে একজনকে বাঁচাতে, আরেকজনকে মায়ের সাথে কৈলাশে পাঠাতে ― কোনটাই হল না। মাঝখান থেকে মার খেয়ে মরলাম আমি। আমি আর বড় হব না, এত মার খেলে রাধুদিদির মত কুঁজো হয়ে থাকব। ঠাম্মা, দেখতো আমার চুল সব উঠে যাচ্ছে কিনা! চুল এইভাবে টানলে উঠে তো যাবেই, চুলের গোড়া কেমন বিড়বিড় করছে।"

ওদিকে টুকটুকির মা হাত জোড় করে ঠাকুরকে বললো, “মেয়েটাকে মানুষ করো মা, সারাদিন অ্যাক্টো করছে, কোনো কথাই শুনছে না।”

টুকটুকি ঠাম্মার কানে কানে বলল, “শুনলে তোমার ছেলের বৌয়ের কথা, আমাকে গাধা বলল।”

“মাগো মা সরস্বতী আমার মাকে বুদ্ধি দাও মা, মানুষ করো।"

ঠাম্মার স্থাণুবত বসে থাকা ছাড়া কোনো উপায় নেই। নাতনি তো কথা বানিয়ে তিল কে তাল করবে, আর ছেলের বৌয়ের কথা না বলাই ভালো। ঠাম্মা চোখ বুজে মালা জপ করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

-সবিতা বিশ্বাস


Popular Books


Comments

  • বর্ণালী বিশ্বাস

    ভালো লাগলো।

    Feb 6 2024
  • Sandip Kumar Panda

    গল্পের চরিত্রগুলোর ঘনঘটায় একটু পড়তে অসুবিধা হচ্ছিল তবে পড়ে ভালো লাগলো। বেশ মোটামুটি ভালো রম্যরচনা ।

    Feb 6 2024
  • Ranu Sil

    ভালোই লাগল। চরিত্র চিত্রণ ভালো।

    Feb 7 2024
  • বিজয়লক্ষ্মী মুখার্জী

    বেশ মজার, ছোটোদের মনের মতো

    Feb 8 2024
  • Sulagna Banerjee

    একেবারে ছোটোদের উপযুক্ত গল্প কিন্তু ছোটোরা এতো চরিত্র পড়তে গেলে গুলিয়ে ফেলে। চরিত্র একটু কমালে আরও ভালো হতো

    Feb 18 2024

Write a Comment